প্রকাশিত:
২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১১:৪৩
বাংলায় একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে, যার এক কান কাটা সে লজ্জায় কাটা কান ঢেকে হাটে। কিন্তু যার দুই কান কাটা সে কোনো কানই ঢাকে না। তার লজ্জাশরমের বালাই থাকে না। পতিত আওয়ামী লীগের কিছু পলাতক, কিছু লুটেরার এখন মনে হচ্ছে দুই কান কাটা।
তাঁদের লজ্জা বলে কিছু নেই। তাঁদের বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই। অতীত বেহায়াপনার জন্য তাঁরা মোটেও অনুতপ্ত নন। ৫ আগস্টে গণ-অভ্যুত্থানের পর তাঁরা প্রায় সবাই বিদেশে পালিয়ে গেছেন।
বিদেশে পালিয়ে তাঁরা কোনো কষ্টের জীবনে নেই। বরং ১৫ বছর ধরে তাঁরা যে লুটতন্ত্র কায়েম করেছিলেন, সেই লুটের টাকায় বিলাসী জীবন যাপন করছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিলাসী জীবনের প্রতিযোগিতাও হচ্ছে। লাজলজ্জাহীনভাবে তাঁরা উৎসব করছেন।
এসব পলাতক নেতা শুধু রাজনীতির জন্যই কলঙ্ক নন, দেশের জন্যও ভয়ংকর বিপজ্জনক। তাঁরাই বাংলাদেশকে ধ্বংসের প্রান্তে নিয়ে গিয়েছিলেন। হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করে দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু বানিয়েছেন এই বেহায়া দুর্বৃত্তরা। তাঁরা এখন আইন ও বিচারের ঊর্ধ্বে। বিদেশে নিরাপদ জীবনে তাঁরা দাঁত কেলিয়ে হাসছেন।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লন্ডনে আওয়ামী লীগের এক নেতার ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠানে পতিত আওয়ামী লীগের চার মন্ত্রীকে দেখা গেল। ভাবলেশহীন এই লুটেরা বিদেশে যেন অবকাশ যাপন করছেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাঁদের নিয়ে এখন সমালোচনার ঝড়। এই ভিডিও তাঁদের প্রবাসজীবনের একটি অংশ মাত্র। আওয়ামী লীগের লুটেরাদের বিদেশে বিত্তের বৈভব আরো বিশাল ব্যাপ্তির। ১৫ বছর আওয়ামী লীগ জোর করে ক্ষমতা দখল করে রেখেছিল। এই সময়ে সুবিধাভোগী, দুর্নীতিবাজ কিছু মন্ত্রী, এমপি সর্বক্ষণ ব্যস্ত ছিলেন লুটপাটে। এই লুটের টাকা তাঁরা দেশে কোনো কাজে লাগাননি।
দেশে বিনিয়োগও করেননি। সব টাকা তাঁরা বিদেশে পাচার করেছেন। অনুসন্ধানে এসব পলাতক লুটেরার বিদেশে বিলাসী জীবনের এক ব্যাপক বিবরণ পাওয়া যাচ্ছে। যুক্তরাজ্য, কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, দুবাই, সিঙ্গাপুর ও ভারতে তাঁরা বিত্তের বিকৃত উৎসব করছেন। রাজার হালে জীবন যাপন করছেন। তাঁদের যে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হচ্ছে কিংবা সম্পদ জব্দ করা হচ্ছে তা কিছুই নয়।
সাগর থেকে এক বালতি জল তুলে নিলে যেমন হয় তাঁদের সে রকম সম্পত্তি জব্দ করা হচ্ছে। তাই তাঁদের বিদেশে পাচার করা অর্থ দ্রুত উদ্ধারের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত বলেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন।
বিদেশে যেসব আওয়ামী লুটেরা সম্পদের পাহাড় গড়েছেন, তাঁদের মধ্যে সবার শীর্ষে আছেন সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী। সাইফুজ্জামান চৌধুরীর যুক্তরাজ্যেই দুই শতাধিক ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্ট, বাড়িঘর রয়েছে। দুবাইয়ে রয়েছে সাতটি অ্যাপার্টমেন্ট। এ ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তিনি দুটি ফ্ল্যাটের মালিক।
এসব বিষয়ে যুক্তরাজ্যে তদন্ত হলেও এখন পর্যন্ত তদন্তের কোনো অগ্রগতি নেই। সাইফুজ্জামান চৌধুরী এখন আওয়ামী লীগের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখছেন না। তিনি লন্ডনেই অবস্থান করছেন। আওয়ামী লীগের কোনো কর্মসূচি বা অন্য কোনো কর্মসূচিতে তাঁকে দেখা যায় না। লন্ডনে তিনি নিজস্ব ব্যবসার কাজে ব্যস্ত। স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে সেখানেই অবস্থান করছেন তিনি।
শীর্ষ লুটেরাদের মধ্যে দ্বিতীয় আলোচিত হলেন সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। তিনি এই মুহূর্তে দুবাইয়ে অবস্থান করছেন। দুবাইয়ে তাঁর বিপুল সম্পদ রয়েছে। এই সম্পদগুলোর মধ্যে বেশ কিছু তাঁর নামে, কিছু তাঁর স্ত্রী পুত্র-কন্যার নামে এবং বাকিগুলো বেনামে।
এই বেনামি সম্পদগুলো থেকে তিনি এখন খরচ করছেন। সম্প্রতি বিপুর ঢাকায় কিছু সম্পত্তি জব্দ করা হয়েছে। তবে এতে তাঁর বিপুল লুটভাণ্ডারের কোনো ক্ষতি হবে না বলেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন। আলোচিত লুটেরাদের মধ্যে তৃতীয় হলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী লোটাস কামাল। দুবাইয়ে তাঁর বিপুল পরিমাণ সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে।
দুবাই ছাড়াও যুক্তরাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও এই লুটেরার বিপুল সম্পদের হদিস পাওয়া যাচ্ছে। বর্তমানে সপরিবারে এই লুটেরা দুবাইয়ে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে, যেখানে একাধিক ব্যবস্থায় বিনিয়োগ করেছেন তাঁর মেয়ে। আ হ ম মুস্তফা কামাল আওয়ামী লীগের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখছেন না। আওয়ামী লীগের লুটেরাদের সবচেয়ে বড় আড্ডাখানা এখন ভারত। তাঁরা সেখানে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, বাড়ি ভাড়া নিয়ে আরাম-আয়েশে জীবন যাপন করছেন।
কলকাতায় যেসব আওয়ামী লুটেরা বিলাসী জীবন যাপন করছেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক মন্ত্রী জাহিদ মালেক, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মাহবুবউল আলম হানিফ, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমসহ আরো অনেকে। তাঁরা প্রত্যেকেই নিউ টাউনে বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট, ফ্ল্যাট নিয়ে বসবাস করছেন। তাঁরা বিপুল পরিমাণ টাকা-পয়সা পাচার করেছেন। বেশির ভাগই পরিবার-পরিজন নিয়ে সেখানে নিরাপদে দিন কাটাচ্ছেন।
বিভিন্ন সূত্র বলছে, ভারতেও এসব লুটেরার বেশ কিছু বেনামি বিনিয়োগ রয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে যে বিনা ভিসায়, বিনা অনুমতিতে তাঁরা এত দিন ধরে ভারতে অবস্থান করছেন কিভাবে?
লুটেরাদের দ্বিতীয় বৃহত্তম অংশ অবস্থান করছে যুক্তরাজ্যে। ৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের এই দুর্নীতিবাজ লুটেরারা পালিয়ে প্রথমে ভারতে যান এবং রহস্যময়ভাবে ভারত থেকে তাঁরা ভিসা সংগ্রহ করতে সক্ষম হন। সেখান থেকে তাঁরা চলে যান যুক্তরাজ্যে। যুক্তরাজ্যে তাঁদের বাড়িঘর সবই আছে। সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী আব্দুর রহমান আগে থেকেই লন্ডনে বাড়ি কিনে রেখেছিলেন। তাঁর মেয়ে সেখানে বসবাস করেন। পালিয়ে যাওয়ার পর তিনি সেখানে তাঁর লুণ্ঠিত বিপুল পরিমাণ সম্পদ নিয়ে রাজার হালে জীবন যাপন করছেন। আরেক সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম। তিনিও ভারত থেকে যুক্তরাজ্যে যান এবং সেখানেই অবস্থান করছেন। শ ম রেজাউল করিমেরও লন্ডনে একাধিক বাড়ি রয়েছে। তাঁর ছেলেমেয়ে সেখানেই থাকেন।
সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ এখন লন্ডনে অবস্থান করছেন। তিনি লন্ডন ও ব্রাসেলস—এই দুই জায়গায় থাকেন। ব্রাসেলসে তিনি একটি কম্পানিও খুলেছেন। হাছান মাহমুদ তাঁর লুণ্ঠিত টাকা যুক্তরাজ্য ছাড়াও দুবাইয়েও রেখেছেন বলে জানা গেছে। লন্ডনে হাছান মাহমুদের তিনটি বাড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে। ব্রাসেলসে তাঁর দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে বলেও তাঁর ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে। তাঁর স্ত্রীর নামে ব্রাসেলসে দুটি ফ্ল্যাট পাওয়া গেছে। হাছান মাহমুদের বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ রয়েছে বেলজিয়ামে। দুবাইয়েও তাঁর বিপুল বিনিয়োগ আছে।
সাবেক নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীরও লন্ডনে বাড়ি রয়েছে। তিনিও ৫ আগস্টের পর পালিয়ে ভারতে যান। পরে তিনি সেখান থেকে লন্ডনে চলে যান। সেখানে তিনি স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। লন্ডনে তাঁর বেশ কিছু ফ্ল্যাট রয়েছে। টানা ১০ বছর নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী থাকা অবস্থায় তিনি ব্যাপক দুর্নীতি করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এই লুটের টাকা সবই তিনি তাঁর ব্রিটিশ নাগরিক স্ত্রীর কাছে পাচার করেছেন। সেই টাকা দিয়ে তিনি এখন রাজার হালে জীবন যাপন করছেন। লন্ডনে তাঁর বেনামি বিনিয়োগ প্রায় হাজার কোটি টাকা।
লুটেরা আওয়ামী লীগ নেতাদের তৃতীয় ঠিকানা হলো সংযুক্ত আরব আমিরাত। দুবাইয়ে প্রচুর লুটেরা আওয়ামী লীগার এখন মহাসুখে দিন কাটাচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে শীর্ষে আছেন নসরুল হামিদ বিপু। সেখানে তাঁর প্রায় হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ এবং ব্যবসা রয়েছে বলে জানা গেছে। আ হ ম কামালেরও দুবাইয়ে বিপুল পরিমাণ বিত্ত ও ব্যবসার সন্ধান পাওয়া গেছে। শামীম ওসমান দুবাইয়ে ছিলেন। দুবাইয়ে তাঁর ব্যবসা ও বাড়িঘর রয়েছে। তবে বর্তমানে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
আওয়ামী লীগের চতুর্থ আবাসস্থল এখন যুক্তরাষ্ট্র। তবে যাঁরা যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী নন তাঁরা এখন সুবিধা করতে পারছেন না। যাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক নন বা গ্রিন কার্ড পাননি তাঁরা এখন অন্য দেশে পাড়ি জমানো শুরু করেছেন। শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী আওয়ামী লীগের বিপ্লব বড়ুয়া এখন যুক্তরাষ্ট্রে। এ ছাড়া অন্তত পাঁচজন সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। তাঁরা ১৫ বছর ক্ষমতায় ছিলেন শুধু নিজেদের আখের গোছানোর জন্য। তাঁরা দেশের জন্য তো কিছু করেনইনি, আওয়ামী লীগের জন্যও কিছু করেননি। আওয়ামী লীগের কর্মীদের জন্যও কিছু করেননি।
তাঁরা বিদেশে কিছুদিন ঘাপটি মেরে থাকলেও এখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরছেন। অনেকেই বিদেশ থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন বটে। তবে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের তাঁরা কোনো ধরনের সহায়তা করছেন না। এ জন্য বাংলাদেশে তৃণমূলের কর্মীরা এখন এসব বেহায়া দুর্বৃত্তকে ‘গণশত্রু’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। তাঁদের বিদেশে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ রয়েছে তা উদ্ধারের জন্য সরকার কী ব্যবস্থা নিচ্ছে, সেটি নিয়ে জনমনে ক্রমেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এই সম্পদগুলো জনগণের। দ্রুত যদি সম্পদগুলো উদ্ধার না করা হয় তাহলে জুলাই বিপ্লবের প্রত্যাশা নষ্ট হবে। অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেছেন, বিভিন্ন দেশে চুক্তি হচ্ছে। বিভিন্ন দেশ থেকে তাঁদের লুণ্ঠিত অর্থ উদ্ধারের চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, এসব সম্পদ উদ্ধারের জন্য দ্রুত আন্তর্জাতিক ফোরামে ব্যবস্থা না নিলে এই লুটের টাকা উদ্ধার করা কঠিন হয়ে যাবে।
মন্তব্য করুন: